জাহাঙ্গীর হোসাইন চৌধুরী ঃ ভয়াবহ মাদক দিন দিন আমাদের দেশ ও জাতিকে গ্রাস করেই চলেছে, যতই দিন যাচ্ছে মাদকের ভয়াবহতা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাদকের দাবানলে পুড়ছে পুরো জাতি। মাদক জনিত সমস্যা থেকে উত্তরণের লক্ষে দেশে নানান পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে, মাদক চোরাচালান রোধ ও মাদক ব্যবসা বন্ধ করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা ও মাদকবিরোধী গণসচেতনতা লক্ষ করা যায় সর্বমহলে, কিন্তু কোন কিছুতেই মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন থেকে মুক্তি পাচ্ছে না দেশ ও জাতি। দেশের অভিজ্ঞ মহলের অভিমত হলো,
মাদক জনিত সমস্যা থেকে আমাদের পরিত্রান না
পাওয়ার অন্যতম কারণ দেশে মাদকদ্রব্যের ব্যাপক
চাহিদা। বিভিন্ন সংস্থার জরিপ বলছে দেশে মাদক
সেবীর সংখ্যা ৭০ লাখেরও অধিক, আর এদের শতকরা ৮০ ভাগই তরুণ ও যুবক। এতো অধিক সংখ্যক মাদকাসক্তের মাদকের চাহিদা পূরণে দেশে মাদক ব্যবসা ও মাদক চোরাচালান বৃদ্ধি পেয়েছে। মাদক চোরাকারবারীরা ও মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের কৌশল পরিবর্তন করে নতুন সব কৌশল আবিষ্কার করে তাদের মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই মাদক জনিত সমস্যা আজ সর্বত্র বিরাজ
করছে। মাদক জনিত সমস্যা আজ অনেক পরিবারের অশান্তির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে, অনেকের সুখের সংসার ভাঙ্গছে, পাশাপাশি সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ঠ হচ্ছে। আমরা যদি দেশ ও জাতিকে মাদক মুক্ত করতে চাই, তাহলে মাদক চোরাচালান ও মাদক ব্যবসা প্রতিহতের পাশাপাশি মাদকের চাহিদাও হ্রাস করতে হবে। ইতিমধ্যে যারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে,
যারা মাদকের মরণ ছোবলে আক্রান্ত হয়ে নিজের
জীবনকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে
তাদেরকে মাদক থেকে মুক্ত করে সুস্থ-স্বাভাবিক
জীবনে ফিরিয়ে এনে দেশ থেকে মাদকের চাহিদা
হ্রাস করতে হবে। দেশে মাদক সন্ত্রাস প্রতিরোধে বিভিন্ন মহলের নানান পদক্ষেপ লক্ষ করা গেলেও মাদকাসক্তদের মাদক থেকে মুক্ত করে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ তেমন একটা লক্ষ করা যায় না। এ ক্ষেত্রে মাদকাসক্তরা চরম ভাবে উপেক্ষিত ও অবহেলিত।
মাদকাসক্তদের তাদের আসক্তি জনিত নানা
অসামাজিক কার্যকলাপ ও অপরাধ মূলক কর্মকান্ডের জন্য আমরা তাদেরকে দ্বায়ী করে তাদেরকে ঘৃণা করি, তাদেরকে নানা ভাবে তিরষ্কার করি, ফলে তাদের মধ্যে অসামাজিক ও অপরাধমূলক কর্মকান্ড আরো ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। ধীরে ধীরে পরিবার ও সমাজের জন্য বোঝা হয়ে উঠে, হয়ে পড়ে পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। আমরা অনেকে তাদের আসক্তি
জনিত কর্মকান্ডের জন্য তাদেরকে দূরে ঠেলে দেই, বা তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাই। অনেকেই সামাজিক অপবাদ ও লোকলজ্জার কারণে পরিবারে কোন সদস্য মাদকাসক্ত থাকলে তার চিকিৎসার কোন উদ্যোগ নেই না। আবার আমাদের সমাজে একটি ভুলধারণা আছে, তা হলো, মাদকাসক্তরা কখনো সুস্থ হয়না, আর সুস্থ হলেও
সুস্থ থাকতে পারেনা। এমনটি ধারণার ফলে আমরা
অনেকেই তাদেরকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য চিকিৎসার কোন উদ্যোগ নেই না। বাস্তবতা হলো, সঠিক চিকিৎসার আওতায় আনলে ও সঠিক পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদেরকে পুনর্বাসিত করলে মাদকাসক্তরাও সুস্থ হয়ে উঠতে পারে, তারাও পারে মাদক মুক্ত হয়ে সুস্থ জীবনে ফিরে এসে তাদের দৈনন্দিন জীবনের কর্মকান্ড
স্বাভাবিক ভাবে চালিয়ে যেতে ।মাদকাসক্তির অর্থ হলো, কোন মাদকদ্রব্যের উপর অসুস্থ
নির্ভরশীলতা, যার উপর ব্যক্তির কোন নিয়ন্ত্রন থাকে
না। যে সকল দ্রব্য মানুষের মন-মানসিকতা পরিবর্তন করে দেয় মাদক তার অন্যতম। একজন ব্যক্তি একদিনে মাদকাসক্ত হয় না, এটা প্রক্রিয়াধীন। কিছুদিন মাদক সেবন করলে এক ধরণের শারীরিক, মানসিক নির্ভরশীলতা তৈরী হয়, ঐ নির্ভরশীলতাকেই বলা হয় মাদকাসক্তি। মাদক নির্ভরশীল হয়ে পড়লে তখন আর মাদক সেবন থেকে দূরে থাকা যায় না, মাদক ব্যক্তির
জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠে। মাদক সেবনের টান তৈরী হলে তখন আর নিজেকে মাদক সেবন থেকে বিরত রাখা য়ায় না। আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরণের মাদক পাওয়া যায়, যেমন: ইয়াবা, হেরোইন, ফেন্সিডিল, আফিম,পেথেডিন, কোকেন, মদ, গাজা, ও ঘুমের ঔষধ সহ নানা রকমের মাদকদ্রব্য। আর এসব মরণ নেশা মাদক সেবন করে আমাদের দেশের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-
যুবতী সহ সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের কিছু অংশ নিজের জীবনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, আবার অনেককেই বরণ করতে হচ্ছে মৃত্যুর মতো ভয়াবহ পরিনতি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মাদকাসক্তি এক ধরণের মাদক জনিত মস্তিষ্কের রোগ, মাদক ব্যক্তির মস্তিষ্কের কেন্দ্রিয় স্নায়ূতন্ত্রকে মারাত্তক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব থাকা সত্তেও মাদক গ্রহণের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পায়। দীর্ঘদিন মাদক সেবনের ফলে মাদকসক্তরা মানসিক রোগীতে পরিনত হয়, মাদক ব্যক্তিকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তবে শারীরিক ক্ষতির পরিমানের চাইতে মানসিক ক্ষতির পরিমান অনেক বেশি, ফলে তাদের জন্য শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসা অপরিহার্য হয়ে উঠে। বিশেষজ্ঞরা বলেন,মাদক জনিত মস্তিষ্কের রোগটি অন্যান্য রোগের চাইতে অনেক জঠিল ও দীর্ঘমেয়াদী, তবে আতংক্ষিত
হওয়ার কিছু নেই, এ রোগের পূনরাক্রমনের প্রবনতা
থাকলেও নিয়ন্ত্রন যোগ্য। ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ রোগ যেমন সঠিক চিকিৎসা ও নিয়মকানুন মেনে চললে সুস্থ থাকা যায়, মাদক জনিত মস্তিষ্কের রোগটিও তেমন, সঠিক চিকিৎসা ও নিয়মকানুন মেনে চললে আজীবন সুস্থ থাকা যায়। মাদক সেবনের ফলে শারীরিক, মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আচরণ ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘঠে, চিন্তা চেতনার নেতিবাচক পরিবর্তন ঘঠে,
তাই তাকে মাদক মুক্ত থাকতে হলে শারীরিক, মানসিক চিকিৎসার পাশাপাশি আচরণ, মূল্যবোধ ও চিন্তা- চেতনার পরিবর্তনের প্রয়োজন, ফলে আসক্ত ব্যক্তিকে দীর্ঘদিন চিকিৎসা ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকতে হয়। অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও কাউন্সিলারদের তত্বাবধানে থেকে শারীরিক ও মানসিক উন্নতির পাশাপাশি আচরণিক, আধ্যাত্বিক, মূল্যবোধ, কর্মজড়তা ও পারিবারিক নানা সমস্যা গুলি কাঠিয়ে উঠার জন্য নিয়মিত কাউন্সিলিং, অকুপেশনাল থেরাপী ও সাইকো থেরাপীর প্রয়োজন। মাদকাসক্তদের শারীরিক,
মানসিক চিকিৎসার পাশাপাশি কাউন্সিলিং গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নিয়মিত কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে মাদকাসক্তির ফলে তৈরী হওয়া ব্যক্তিগত ও
পারিবারিক সমস্যা গুলি কাঠিয়ে উঠতে হয়। ফলে
একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির জন্য চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে ৪ থেকে ৬ মাস থাকা আবশ্যক। মাদকাসক্তির চিকিৎসার ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়, যেহেতু পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বা রিহেবিলিটেশন প্রক্রিয়া দীর্ঘ মেয়াদী অনেক দিন লাগে, তাই অনেকেই ডিটক্সিফিকেশন (ঔষধ নির্ভর স্বল্পমেয়াদী চিকিৎসা) পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে মাদকমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এখানে মনে
রাখতে হবে, ডিটক্সিফিকেশন চিকিৎসা কেবল
মাদকাসক্তি চিকিৎসার প্রথম ধাপ মাত্র, তাই
মাদকাসক্তদের ডিটক্সিফিকেশন চিকিৎসার
পাশাপাশি রিহেবিলিটেশন বা পুনর্বাসন প্রক্রিয়া
মাধ্যমে চিকিৎসা খুবই গুরুত্বপুর্ণ। চিকিৎসার এসকল ধাপ সঠিক ভাবে সম্পন্ন করতে পারলে ও চিকিৎসা পরবর্তীতে চিকিৎসক ও কাউন্সিলরদের পরামর্শ মেনে চললে সুস্থ থাকা সম্ভব। তবে অসম্পূর্ণ চিকিৎসা সুস্থতার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাড়াতে পারে। অসম্পূর্ণ চিকিৎসার ফলে মাদক জনিত মস্তিষ্কের রোগটির পুনরাক্রমনের
প্রভাবে সুস্থতা প্রাপ্ত ব্যক্তি পুণরায় মাদকে ফিরে
যেতে পারে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, মাদকাসক্তি একটি মানসিক অসুস্থতা, অন্যান্য রোগীদের মতো মাদকাসক্তরাও রোগী। অন্যান্য রোগীদের মতো তাদেরও প্রয়োজন চিকিৎসা। তাই মাদকাসক্তদের প্রতি ঘৃণা বা অবহেলা নয়, তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তাদের জন্য সঠিক চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদেরকে মাদক মুক্ত হয়ে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য তাদেরকে উদ্যোগী করে তুলতে হবে, এক্ষেত্রে আসক্ত ব্যক্তির পরিবারের ভ’মিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাদকাসক্তি লুকানোর কিছু নেই, যে কোন বয়সের যে কেউ মাদকাসক্ত হতে পারে, মাদকাসক্তি অপরাধ নয়, একটি
অসুস্থতা। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, একজন
মাদকাসক্ত ব্যক্তি একটি সুন্দর পরিবার ধ্বংস করে
দেওয়ার জন্য যতেষ্ট। তাই আসুন, আমরা সবাই
মাদকাসক্তদের সঠিক চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে তাদেরকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য এগিয়ে আসি, মাদক মুক্ত দেশ ও জাতি গড়ি।
লেখক: মাদকবিরোধী সংগঠক ও সমাজকর্মী